আমাদের শরীরের সুস্থতার জন্য খাবারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্তপূর্ণ। কারণ খাবারের মাধ্যমেই আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুষ্টি পায়। সঠিকভাবে কাজ করতে পারে। কিন্তু আমরা সুস্থ থাকার জন্য এ গুরুত্তপূর্ণ জিনিসটির প্রতিই অবহেলা বেশি করে থাকি। আজেবাজে খাবার খেয়ে শরীরের কর্মক্ষমতা কমিয়ে ফেলি।কিন্তু এটা ঠিক নয়। এ বিষয়ে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। ভালো খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার।
সুস্থ থাকতে প্রতিদিন ৭ টি সবজি
ব্রকলিঃ ব্রকলি খেতে অনেকেই পছন্দ করেন না। কিন্তু শরীরকে সুস্থ এবং নিরোগ রাখতে চাইলে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখুন এ পুষ্টিগুণে ভরপুর সবজিটি। ভিটামিন কে, বি এবং পুষ্টিগুণে ভরপুর এ সবজিটি আমাদের হাড় এবং দাঁত মজবুত করতে সাহায্য করে। প্রতিদিন ব্রকলি খেলে বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সারের হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়।
টমেটোঃ টমেটোতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে লাইকোপিন। লাইকোপিন নামক এ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টটি আমাদের ব্লাডার, পাকস্থলী এবং কোলন ক্যান্সারের হাত থেকে রক্ষা করে। প্রতিদিন অন্তত একটি টমেটো খাদ্যতালিকায় অবশ্যই রাখা উচিত।
ভুট্টাঃ ভুট্টা অনেকেই বেশ পছন্দ করেন। ভুট্টা খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ভালো। ভুট্টায় রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট, ফাইবার এবং নিউট্রিশন। এতে খুব কম পরিমাণে ক্যালরি থাকায় যে কেউ খেতে পারেন।
তিসীঃ এখোনো অনেকে বেশ মজা করে তিসীবাটা ভর্তা খান। কিন্তু অনেকের কাছেই গ্রামবাংলার এ খাবারটি অজানা। অনেকেই জানেনে না তিসী আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ভালো। তিসীতে রয়েছে উদ্ভিজ্জ ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড যা মাছের মধ্যে বিদ্যমান। তিসী আমাদের শিরা উপশিরায় ব্লক খুলতে বেশ কার্যকরী। এবং তিসী স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
মিষ্টি কুমড়োঃ মিষ্টি কুমড়োয় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে বিটা ক্যা্রোটিন যা হৃদপিন্ডের যেকোন ধরেণের রোগ থেকে আমাদের রক্ষা করতে সাহায্য করে। এছাড়াও অনেক কম ক্যালরির এ মিষ্টি কুমড়োয় রয়েছে ফাইবার এবং ভিটামিন ‘এ’ – যা আমাদের শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং চোখের সুস্থতায় কাজ করে।
গাজরঃ প্রচুর পরিমাণে ক্যারোটিনসমৃদ্ধ এ কমলারঙের সবজিটি আমাদের নানা ধরণের ক্যান্সার, মাংসপেশীর ক্ষয়, রাতকানা রোগ এবং শরীরের খারাপ কোলেস্টেরলের বিরুদ্ধে কাজ করে। প্রতিদিন গাজর খেলে ত্বকের নানা সমস্যা থেকেও দূরে থাকা সম্ভব।
মিষ্টি আলুঃ বিটা ক্যারোটিন, আয়রন, ভিটামিন সি এবং ভিটামিন ই- তে ভরপুর মিষ্টি আলু প্রতিদিন খেলে শরীরের ক্ষয় হয়ে যাওয়া এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া কোষ ঠিক হতে সাহায্য করে। এটি মাংপেশী সুগঠনেও কাজ করে এবং ক্যান্সার কোষ গঠনে বাঁধা দেয়।
এক গবেষণায় দেখা যায়, জাপান ছাড়া অন্যসব উন্নত দেশে মানুষের জীবণযাপন প্রায় এক রকম। জাপানিদের খাওয়া-দাওয়া সুষম ও সাস্থ্যসম্মত বলে সেখানে স্থূলতা এখনো মহামারি আকারে দেখা দেয় নি। কিন্তু অন্যান্য উন্নত দেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে খাবার দাবারের প্রাচুর্য চোখে পরার মত, দামেও সস্তা। উন্নত বিশ্বের শিশু কিশোর এমনকি প্রাপ্তবয়স্কদের পছন্দের খাবারের তালিকায় রয়েছে আইসক্রিম, জাঙ্কফুড এবং প্রচুর চিনি সমৃদ্ধ কোমল পানীয়। প্রায়ই সবগুলো আইটেমই হয় জাম্বো সাইজের। ক্যালোরিতে ভরপুর এসব খাবার ঘনঘন খেলে যেকোন শিশু অল্পসময়ের মধ্যে মোটা হতে শুরু করলেও তাদের খাবারের প্রতি অনীহা থাকে না এবং আকর্ষন বাড়ে অতিমাত্রায়। খাবারের প্রতি আকর্ষন মানুষকে আরও বেশি পরিমাণে খেতে প্রলুব্ধ করে। ফলে ওজনও বাড়ে সমানতালে।
বিশ্বে দেড় কোটি ক্ষুধার্ত শিশু মারা যায় প্রতি বছর। বিশ্ব সাস্থ সংস্থার (WHO) মতে,পৃথিবীর প্রায় ১০০ কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ক্ষুধার্ত।ক্ষুধার তাড়নায় প্রতি ৩.৬ সেকেন্ডে একজন মারা যায়। বিশ্বব্যাংকের এক পরিসংখানে বলা হয়েছে, অপুষ্টিতে আক্রান্ত এসব মানুষের ৮০ শতাংশ শিশু এবং মহিলা। বিশ্বসাস্থ্যসংস্থার মতে, উন্নয়নশীল এবং গরীব দেশগুলোর মধ্যে প্রায় ৫০ কোটি শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। প্রতি বছর ৫ বছরের কম বয়স্ক প্রায় ৮৫ লাখ শিশু নামেমাত্র বেঁচে থাকলেও ক্ষুধার কারনে কোনো না কোনো সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
আসা যাক একটি বিপড়ীতধর্মী প্রসঙ্গে। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের শিশুদের অতিরিক্ত স্থূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। মেয়রদের সম্মেলনে বক্তৃতাকালে তিনি বলেন, স্থূলতা মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে এবং এ স্থূলতা আমেরিকার সাস্থ্য ও অর্থনীতির জন্য এক মহাবিপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। শরীরে মাত্রাতিরিক্ত চর্বি জমা হলে মানুষ অস্বাভাবিক মোটা হয়ে যায়। জেনেটিক বা জৈবিক কারন ছাড়াও মানুষের জীবণ পদ্ধতি স্থূলতার জন্য বিষেশভাবে দায়ী। সহজ ভাষায়, মানুষ খাবারের মাধ্যমে বেশি পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করার পর যৎসামান্য ক্যালরি খরচ করলে অর্থাৎ পর্যাপ্ত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম না করলে ওজন বাড়তে শুরু করে। কিন্তু ক্যালরি গ্রহণ এবং খরচের মধ্যে ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, স্থূলতার সংগে প্রাচুর্যের একটি নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে।যাদের অনেক টাকাকড়ি আছে,তারা প্রচুর ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার বেশি খেয়ে থাকেন এবং ঘন ঘন খান। প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ক্যালরি শরীর কাজে লাগাতে পারে না। তাই বাড়তি ক্যালরি চর্বিতে রূপান্তরিত হয়ে শরীরে জমা হয়।
আমাদের শরীরের ওজন স্বাভাবিক আছে কিনা জানবো কিভাবে?
একটা অংক করে আমরা উত্তরটা বের করি। কারো শরীরের ওজন স্বাভাবিক না বেশী তা জানা হয় বডি মাস ইন্ডেক্স বা বিএমআই দিয়ে। বিএমআই নির্ণয়ের নিয়মটা মনে রাখতে হবে।
শরীরের ওজনকে উচ্চতার বর্গফল দিয়ে ভাগ করলে যে ফল পাওয়া যায় সেটাই বিএমআই। ১৮.৫ থেকে ২৪.৯ হলো স্বাভাবিক বিএমআই স্কেল। কারো শরীরের ওজন ৬৮ কেজি এবং উচ্চতা ১.৭৩ মি. হলে তার বিএমআই হবে ৬৮ ভাগ (১.৭৩*১.৭৩) = ২২.৭৪ । ফলাফল অনুযায়ী উক্ত ব্যাক্তির ওজন একেবারেই সঠিক। বিএম আই ২৪.৯ এর চেয়ে বেশি হলে ওজন স্বাভাবিক এর তুলনায় বেশি এবং ১৮.৫ এর চেয়ে কম হলে ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম ধরা হয়। মনে রাখা জরুরি শরীরের ওজন বাড়িয়ে বা কমিয়ে বিএমআই স্বাভাবিক পর্যায়ে আনার সুযোগ রয়েছে।
ওজন কমানোর ঔষুধগুলো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মুক্ত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের হেলথ রিসার্চ গ্রুপের পরিচালক ড. সিডনি ওলফ বলেন, এমন কোনো ঔষুধ পাওয়া সম্ভব নয় যা শুধু নিরাপদে ওজন কমাবে এবং কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকবে না।
স্থূলকায় লোকদের উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস ছাড়াও স্ট্রোক এবং হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক বেশী থাকে। ওজন কমানোর ঔষুধ প্রদানের মাধ্যমে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে স্ট্রোক এবং হৃদরোগের ঝুঁকি আরো অনেকগুণ বেড়ে যায়। এটা অনেকটা মরার ওপর খাঁড়ার ঘা এর মতো। শুধু বেশী খাবার খাওয়ার জন্যই সবসময় ওজন বাড়ে না। ওজন বাড়ার সঙ্গে খাবার ছাড়াও পরিবেশসহ সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক, আবেগ, জৈবিক এবং বহু কারণ জড়িয়ে আছে। এতগুলো বহুমুখি সমস্যা সমাধানে একটি মাত্র ঔষুধ আবিষ্কার রিতীমতো অসম্ভব ব্যাপার। আজকের বিশ্বায়নের যুগে সব দেশেই ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবারের সঙ্গে লবণ, চিনি ও চর্বি জুড়ে তার স্বাদ বাড়ানো হচ্ছে। অপরদিকে সামাজিক স্ট্যাটাস এবং বিজ্ঞাপণ আমাদের অতিভোজনে প্ররোচিত করছে। লোভনীয় খাবারের ছবি ও বর্ণনা আমাদের লোভকে অতিমাত্রায় উসকে দিচ্ছে। তাই আমরা খাচ্ছি আর মোটা হচ্ছি।
এমতাবস্থায় আমাদের করণীয় কি?
করণীয় অবশ্য একটা আছে। সেটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আমাদের সব ধরনের লোভ সংবরণ করতে হবে। কথায় আছে- যার জিহ্বা সংযত তার স্বাস্থ্য সুসংহত। খারের মাধ্যমে অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ করা হলে তা জ্বালিয়ে দিতে হবে, জমানো যাবে না। সেই খাবার উৎকৃষ্ট, যে খাবার সুষম। আমাদের একটু কষ্ট করতে হবে ক্যালরি জ্বালাতে হলে। সেক্ষেত্রে ব্যায়াম এবং শারিরীক পরিশ্রমই হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট পদ্ধতি। জীবণযাপনে পরিবর্তন আনা, সুষম খাদ্য গ্রহণ,কায়িক পরিশ্রম, ব্যায়াম মানুষকে মানসিক এবং শারিরীকভাবে সুস্থ্ রাখে। শরীর সুস্থ ও সবল থাকলে মানুষকে দেখতেও আকর্ষণীয়,স্মার্ট ও সুন্দর লাগে। সবাইতো নিজেকে একটু আকর্ষণীয় করে রাখতেই চায়।